নেচার কিওর সেন্টার বা প্রাকৃতিক আরোগ্য কেন্দ্রের উদ্বোধন উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে সমবেত অতিথিবৃন্দ ও আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের নমস্কার জানাই। অনলাইন ও টেলিভিশনে যাঁরা এই অনুষ্ঠান দেখছেন তাঁদেরকেও আমার নমস্কার জানাই। ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, আন্তর্জাতিক যোগ দিবস উপলক্ষে অনেক শুভেচ্ছা।
হিমালয়ের পাদদেশে সুন্দর ও মনোরম শহর দেরাদুনে আজ সকালে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে সমাজের নানা শ্রেণীর হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে সামিল হতে পেরে আমি আনন্দিত। সারা বিশ্ব জুড়ে বিগত কয়েকদিন ধরে যোগ দিবস উদযাপন উপলক্ষে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের ছবি আমি দেখেছি। নিঃসন্দেহে বিগত তিন বছরের মধ্যেই এই কর্মসূচি সারা বিশ্ব জুড়ে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশে যোগচর্চা সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের অভিন্ন অংশ হয়ে উঠেছে। যোগ দিবস উদযাপনের পাশাপাশি, এর প্রভাব বহু দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। ভারতে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে আমি তিনটি ভিন্ন বিষয় উপলব্ধি করেছি। আমি নিশ্চিত, এই ধরণের ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি অন্যান্য দেশেও হয়ে থাকে।
প্রথমত, যোগের মানসিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণে তাঁরা নিজেরাই শপথ নিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, যাঁরা ইতিমধ্যেই যোগ’কে জীবনের অভিন্ন অংশ হিসাবে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের কাছেও যোগ দিবস উদযাপন অনুষ্ঠান নিজেদেরকে পুনরায় অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে উৎসর্গ করার মুহূর্ত হয়ে উঠেছে।
তৃতীয় বিষয় হ’ল, যোগের উপকারিতার কথা ছড়িয়ে দেওয়া। হাজার হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, যারা যোগ থেকে ইতিমধ্যেই লাভবান হয়েছেন, তাঁদের কর্তব্য সেই সমস্ত মানুষের কাছে যাওয়া যাঁরা এখনও যোগের সুফল উপলব্ধি করতে পারেননি। এইভাবে, আন্তর্জাতিক যোগ দিবস বিশ্বের অনেকের কাছেই উৎসব হিসাবে উদযাপিত হবে। যোগ শব্দের অর্থ হ’ল – ‘ঐক্যবদ্ধ করা বা হওয়া’। তাই, যোগের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস নিহিত রয়েছে, তা আমাকে আশাবাদী করে তোলে। আমি আশা করি, যোগ সমগ্র বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ রাখার মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
এই নেচার কিওর সেন্টার উদ্বোধনের জন্য আপনি আন্তর্জাতিক যোগ দিবসকে বেছে নেওয়ায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমি আশা করি, এই কেন্দ্রটি তার সমস্ত কর্মসূচি ও উদ্যোগে যোগের উপাদানগুলিকে ব্যাপকভাবে অঙ্গীভূত করার চেষ্টা করবে।
বন্ধুগণ,
যোগ ও আয়ুর্বেদের মতো ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় জ্ঞানের পদ্ধতিগুলি আমাদের স্বাস্থ্যবান রাখতে সাহায্য করে। দেহ ও মনের সহজাত দুর্বলতাগুলি থেকে মুক্তি দিতে যোগ ও আয়ুর্বেদ সাহায্য করে। প্রাচীন এই জ্ঞান-পদ্ধতিগুলি প্রত্যেককে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে থাকে। প্রচলিত চিকিৎসা-পদ্ধতির সুবিধা যাঁরা গ্রহণ করেছেন, তাঁদের কাছে প্রাচীন জ্ঞান-পদ্ধতিগুলি এক নতুন তেজ-শক্তি নিয়ে এসেছে। আধুনিক জীবনযাপনের বিরূপ প্রভাব দেহ ও মনের ওপর পড়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগ-প্রতিরোধের চেয়ে আরোগ্যলাভে বেশি জোর দেওয়া হয়। একথা নকচ করার কোনও উপায় নেই যে, বর্তমান সময়ের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি দূর করতে আমাদের প্রচলিত ওষুধপত্রের প্রয়োজন। কিন্তু এটাও ঘটনা যে, স্বাস্থ্য সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে এমন কিছু ফাঁক-ফোকর থেকে যাচ্ছে, যার ওপর নজরই দেওয়া হচ্ছে না। সমগ্র বিশ্বের স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরাও এখন একথা স্বীকার করেছেন যে, যোগ ও আয়ুর্বেদের মতো প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি সমসাময়িক চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে। এই ঐতিহাসিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগী কল্যাণ ও রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি গ্রহণ করলে ব্যক্তি তথা সমাজের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ বৃদ্ধি পাবে। কিছু মানুষের ভিন্ন ধারণা সত্ত্বেও একথা বলা যায় যে, যোগ কেবল ব্যায়াম ও দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনের মধ্যেই সীমিত নয়। মন, দেহ ও মানসিকতার গভীরে প্রোথিত রয়েছে যোগ। যোগ নিজেকে আরও ভালোভাবে বোঝার সুযোগ করে দেয়। যোগের মধ্যে গভীর আদর্শ নিহিত রয়েছে, তা আমাদেরকে পাপ থেকে মুক্তির অথবা ভয়কে জয় করার পথে হাঁটতে সাহায্য করে।

বন্ধুগণ,
আমি সবসময় বিশ্বাস করে এসেছি যে, যোগের কোনও ধর্ম হয় না। যোগচর্চার মধ্যে এমন কিছু ব্যবহারিক বা ফলিত পদক্ষেপ রয়েছে, যার মধ্যমে প্রত্যেকেই লাভবান হতে পারেন। এমনকি, তাঁরাও লাভবান হতে পারেন, যাঁরা নিজেদের কোনও জাতি বা ধর্মের মানুষ হিসাবে গণ্য করেন না। আধুনিক যোগচর্চায় প্রায়শই প্রাচীন জ্ঞানের বিভিন্ন উপাদান লক্ষ্য করা যায়। এই সমস্ত উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে – নৈতিক ও শাস্ত্রগত আদর্শ, শরীরকে সুস্থ রাখতে বিভিন্ন ভাবভঙ্গি, আধ্যাত্মিক আদর্শ, গুরুর নির্দেশ ও নিয়মাবলী, মন্ত্রোচ্চারণ, শ্বাস ত্যাগ ও একাগ্রতার মধ্যে মস্তিষ্ককে স্থির রাখা। ব্যক্তিবিশেষের জীবনযাপন পরিবর্তনে যোগচর্চায় গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে জীবনশৈলীর সঙ্গে জড়িত সমস্যাগুলি সহজেই প্রতিরোধ ও সমাধান করা যায়। যোগ-বিশেষজ্ঞরা দৈনন্দিন যোগচর্চাকে পরম লাভবান হিসাবে গণ্য করে থাকেন। এরফলে, স্বাস্থ্য, আবেগ, মানসিক শান্তি ও সুখী জীবনযাপনে উন্নতি ঘটে। এমন বিশ্বাসও রয়েছে যে, নির্দিষ্ট কয়েকটি যোগাভ্যাস ও প্রাণায়ামের মাধ্যমে বেশ কিছু অসুখ-বিসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আধুনিক বিজ্ঞান এখন এ বিষয়ে প্রামাণ্য সাক্ষ্য অনুসন্ধানে উদ্যোগী হয়েছে। বিজ্ঞানও একথা স্বীকার করেছে যে, যোগচর্চার মাধ্যমে দেহের বহু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যেমন – হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও অন্তর্গ্রন্থির নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্ম ও পরিচালন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আজ পশ্চিমী দেশগুলিতে যোগের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একথা বলা অতিরঞ্জিত হবে না যে, পশ্চিমী দুনিয়ায় যোগ ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। আমাকে জানানো হয়েছে যে, কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ২ কোটিরও বেশি মানুষ যোগচর্চা করছেন। শুধু তাই নয়, এই সংখ্যা বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একাধিক আধুনিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন রোগের বিকল্প বা আনুষঙ্গিক চিকিৎসা-পদ্ধতি হিসাবে যোগকে গ্রহণ করেছে। দেরীতে হলেও যোগচর্চা সম্বন্ধে বহু গবেষণা শুরু হয়েছে। ভারত সরকারও জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রামাণ্য সাক্ষ্য-ভিত্তিক পরম্পরাগত স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা রূপায়ণে অঙ্গিকারবদ্ধ। আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি গত বছর ঘোষিত হয়। এই নীতিতে অসুখ-বিসুখের প্রতিরোধে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অ-সংক্রমিত রোগগুলির প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী কর্মসূচি আমরা শুরু করেছি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারত। আজ যে উদ্যোগগুলি নেওয়া হচ্ছে, তার সুফল পেতে কয়েক বছর লাগবে। কিন্তু আমি দৃঢ় বিশ্বাসী যে, বাস্তবিক ফল শীঘ্রই পাওয়া যাবে।
পরিশেষে, আমি আরও একবার বলতে চাই যে, এই প্রাকৃতিক আরোগ্য কেন্দ্রটি যোগের সুফলগুলি তুলে ধরতে কাজ করবে। জীবনে একটু স্বাচ্ছন্দ্য ও খুশির জন্য যাঁরাই এখানে আসবেন, তাঁরা যোগের সুফল উপলব্ধি করতে পারবেন। ব্যক্তি-বিশেষের নিজস্ব উদ্বেগ দূর করতে এই কেন্দ্রটি কল্যাণের যে পথ বেছে নিয়েছে, তা জানতে পেরে আমি খুশি হয়েছি। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই রোগী কল্যাণ কেন্দ্রটির উদ্দেশ্য জীবনব্যাপী কল্যাণসাধন করা। আমি একথাও স্বীকার করি যে, বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপের প্রতি আস্থা ও প্রত্যয় সহজাত। এ ধরণের উদ্দেশ্য নিয়ে এই কেন্দ্রটি রোগী কল্যাণে লক্ষ্যণীয় অবদান রাখবে এবং যোগচর্চার উপকারিতার কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। আমি এটা জেনেও খুশি হয়েছি যে, এই কেন্দ্রটির মাধ্যমে ৫০০ জন মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান এবং ১৫ হাজার মানুষের পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এই উদ্যোগের জন্য আপনাদের সকলকে আমরা শুভ কামনা জানাই।
ধন্যবাদ। অনেক অনেক ধন্যবাদ।


