২১ অক্টোবর, ২০২১। ভারত ১০০ কোটি ডোজ টিকাকরণ সম্পন্ন করল। টিকাকরণ কর্মসূচি শুরুর মাত্র ন’মাসের মধ্যেই এল এই সাফল্য। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় এ এক দুরূহ যাত্রা! বিশেষত ২০২০ সালের গোড়ার দিকে কী পরিস্থিতি ছিল, তা ফিরে দেখলেই আমরা বুঝতে পারব। ১০০ বছর বাদে মানব সমাজ আরও এক অতিমারির কবলে। এবং কেউ বিশেষ কিছু জানতও না এই ভাইরাস সম্পর্কে। মনে পড়ে, কেমন এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেই সময়! দ্রুত চরিত্র বদল করা এক অজানা, অদৃশ্য শত্রুর মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা।
সেই আশঙ্কা থেকে আশ্বাসের পথে যাত্রার সূচনা হল। ক্রমে বিশ্বের বৃহত্তম টিকাকরণ অভিযানের সুবাদে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল আমাদের দেশ।
সমাজের একাধিক অংশকে সঙ্গে নিয়ে এটা সত্যিই ভগীরথের মতো এক প্রয়াস। চেষ্টার মাত্রাটা বুঝতে গেলে একটা ছোট্ট তথ্য জেনে রাখা দরকার। প্রতিটি টিকা দিতে একজন স্বাস্থ্যপরিষেবা কর্মীর সময় লাগে ২ মিনিট। সেই অনুযায়ী এই সাফল্যে পৌঁছতে লেগেছে প্রায় ৪১ লক্ষ মানব-দিবস অথবা আনুমানিক ১১ হাজার মানব-বর্ষের চেষ্টা।
বড় মাত্রার যে কোন প্রয়াসে দ্রুত সাফল্য অর্জন করতে হলে সবার আস্থা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। এই অভিযানের সাফল্যের অন্যতম কারণ সেটাই। এই টিকাকরণ এবং তার পরবর্তী প্রক্রিয়ার উপর আস্থা রেখেছে মানুষ। যদিও অনাস্থা এবং আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা কম হয়নি।
আমাদের মধ্যে কেউ কেউ শুধুমাত্র বিদেশি ব্র্যান্ডে আস্থা রাখেন। এমনকী সেটা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রেও। তবে, কোভিড-১৯ টিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভারতবাসী সর্বসম্মতিক্রমে আস্থা রেখেছে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ ভ্যাকসিনের উপর। এটা এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।
নাগরিক এবং সরকার যদি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে জন ভাগিদারীর আদর্শকে সামনে রেখে এক হয়ে যায়, তাহলে ভারত যে কী করতে পারে এই টিকাকরণ অভিযান তার একটি উদাহরণ। ভারত যখন টিকাকরণ অভিযান শুরু করে, তখন অনেকেই ১৩০ কোটি মানুষের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। কেউ বলেছিলেন, তিন-চার বছর সময় লাগবে ভারতের। কারও কারও দাবি ছিল, মানুষ টিকা নিতে এগিয়ে আসবেন না। এমনও অনেকে ছিলেন, যাঁরা বলেছিলেন, গোটা বিষয়টি অব্যবস্থার চূড়ান্ত হবে এবং টিকাকরণ প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এমনকী কেউ কেউ তো এও বলেছিলেন যে, ভারত সরবরাহ শৃঙ্খল অটুট রাখতে পারবে না। কিন্তু জনতা কারফিউ এবং তার পরবর্তী লকডাউনের মতোই ভারতবাসী দেখিয়ে দিয়েছে, তাঁদের আস্থাভাজন অংশীদার করে তোলা গেলে কী অভাবনীয় ফলই না হতে পারে।
যখন সকলে এগিয়ে আসেন, তখন অসম্ভব বলে কিছুই থাকে না। আমাদের স্বাস্থ্যপরিষেবা কর্মীরা পাহাড়ে চড়ে, নদী পেরিয়ে দুর্গম জায়গায় পৌঁছে গিয়েছেন মানুষকে টিকা দিতে। ভারতে টিকা নিয়ে অনাগ্রহীর সংখ্যা ছিল বেশ কম, যা অনেক উন্নত দেশেও দেখা যায়নি। তার জন্য আমাদের যুব সমাজ, সমাজকর্মী, স্বাস্থ্য পরিষেবা কর্মী, সামাজিক এবং ধর্মীয় নেতাদের প্রত্যেকেরই অভিনন্দন প্রাপ্য।
টিকাকরণ অভিযানে অগ্রাধিকার চেয়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিভিন্ন রকম চাপ ছিল। কিন্তু সরকার এটা নিশ্চিত করেছে যে, অন্য অনেক কর্মসূচির মতো টিকাকরণ অভিযানেও কোন ভিআইপি সংস্কৃতি থাকবে না।
২০২০-র গোড়ায় যখন কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে, তখন থেকেই আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার ছিল যে, টিকার সাহায্য নিয়ে এই অতিমারির মোকাবিলা করতে হবে। সেইমতো আমরা প্রস্তুতি শুরু করে দিই। বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী গঠন করি। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকেই একটি রোডম্যাপ সাজিয়ে ফেলি।
আজ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি দেশই নিজেরা টিকা তৈরি করতে পেরেছে। ১৮০টিরও বেশি রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে কয়েকটি মাত্র উৎপাদকের ওপরেই নির্ভরশীল। বেশ কিছু দেশ এখনও টিকা হতে পাওয়ার অপেক্ষায়। সেখানে ভারত ১০০ কোটি ডোজের মাত্রা অতিক্রম করে গিয়েছে! একবার পরিস্থিতিটা ভাবুন—যদি ভারতের নিজস্ব টিকা না থাকত, তাহলে ভারত কীভাবে এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করত? এবং তার জন্য কত বছর সময় লাগত? এখানেই অভিনন্দন জানাতে হয় ভারতীয় বিজ্ঞানী এবং উদ্যোগপতিদের, যাঁরা সময়মতো এগিয়ে এসেছেন। তাঁদের প্রতিভা এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্যই আজ টিকার ক্ষেত্রে ভারত সত্যিকারের আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছে। আমাদের টিকা নির্মাতারা এই বিশাল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে উৎপাদনও বাড়িয়েছেন, যার থেকে প্রমাণ হয়েছে যে তারা অদ্বিতীয়।
যে দেশে সরকারকে সাধারণত এগিয়ে চলার পথে বাধা হিসেবে ধরা হয়, সেখানে আমাদের সরকার প্রগতিকে গতি দিয়েছে এবং নিশ্চিত করেছে। প্রথম দিন থেকেই টিকা প্রস্তুতকারকদের পাশে থেকেছে সরকার। প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, অর্থদানের পাশাপাশি বিধিনিয়ম প্রক্রিয়ার গতি এনে সাহায্য করেছে। সরকারের সব মন্ত্রক একসঙ্গে টিকা প্রস্তুতকারকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। অপসারণ করা হয়েছে যে কোনও বাধা। ভারতের মতো বিশাল দেশে শুধু টিকা প্রস্তুত করাই যথেষ্ট নয়। নজর দিতে হয়েছে শেষ বিন্দু পর্যন্ত তা পৌঁছনো এবং বাধাহীন লজিস্টিকসের উপর। যে সমস্যাগুলি ছিল, তা বুঝতে হলে ভ্যাকসিনের একটি ভায়ালের যাত্রার কথাটা ভাবুন। পুনে অথবা হায়দরাবাদের একটি কারখানা থেকে ভায়াল পাঠানো হয় যে কোনও রাজ্যের একটি হাবে। সেখানে থেকে সেটি জেলার হাবে যায়। সেই হাব থেকে তা পৌঁছে দেওয়া হয় টিকাকরণ কেন্দ্রে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিমান অথবা ট্রেনে কয়েক হাজার ট্রিপ। এই সম্পূর্ণ যাত্রাপথে টিকার ভায়াল একটি নির্দিষ্টমাত্রায় তাপমাত্রায় রাখতে হয়, যা কেন্দ্রীয়ভাবে তত্ত্বাবধানে থাকে। এর জন্য ১ লক্ষের বেশি কোল্ডচেন উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। আগেভাগেই টিকা সরবরাহের সূচি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যগুলিকেও। যাতে তারা ভালোভাবে সব পরিকল্পনা করতে পারেন এবং টিকাও পূর্বনির্ধারিত দিনেই তাদের কাছে পৌঁছয়। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব প্রয়াস।
এই সমস্ত প্রয়াসকে সাহায্য করেছে কো-উইনের মতো একটি শক্তিশালী টেক প্ল্যাটফর্ম। টিকাকরণ অভিযান যাতে সুষ্ঠু ও সঠিক মাত্রায় হয়, যাতে নজর রাখা যায় এবং স্বচ্ছতা বজায় থাকে—তা নিশ্চিত করেছে কো-উইন। এর ফলে স্বজনপোষণ বা লাইন ভেঙে আগেভাগে যাওয়ার কোন জায়গাই ছিল না। একজন গরিব শ্রমিক নিজের গ্রামে প্রথম ডোজটি নিলেও নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে যাতে শহরের কর্মস্থলে এসে দ্বিতীয় ডোজটি নিতে পারেন, সেটাও নিশ্চিত করা হয়েছে। স্বচ্ছতা বাড়াতে রিয়েল টাইম ড্যাশবোর্ডের পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে কিউআর কোড দেওয়া সার্টিফিকেট। যাতে পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চয়তা মেলে। এই ধরণের প্রয়াসের নজির শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বে বিরল।
২০১৫ সালে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে আমি বলেছিলাম যে, আমাদের দেশ সামনের দিকে এগচ্ছে ‘টিম ইন্ডিয়া’-র জন্য। এই ‘টিম ইন্ডিয়া’ আমাদের ১৩০ কোটি মানুষের একটি বড় দল। মানুষের অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা যদি ১৩০ কোটি ভারতীয়ের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ চালাই, তাহলে দেশ প্রতি মুহূর্তে ১৩০ কোটি পা এগিয়ে যাবে। আমাদের টিকাকরণ অভিযান আরও একবার দেখাল এই ‘টিম ইন্ডিয়া’-র ক্ষমতা। টিকা কর্মসূচিতে ভারতের সাফল্য সারা বিশ্বকে এও দেখাল যে, ‘গণতন্ত্র করে দেখাতে পারে’!
বিশ্বের বৃহত্তম টিকাকরণ অভিযানে যে সাফল্য পাওয়া গিয়েছে, তা আমাদের যুব সমাজ, উদ্ভাবক এবং সরকারের সব স্তরকে জনপরিষেবায় নতুন মাত্রা পৌঁছতে উৎসাহিত করবে বলেই আমি আশাবাদী। আর সেটা শুধু আমাদের দেশ নয়, সারা বিশ্বের কাছে হয়ে উঠবে একটি মডেল।

Explore More
প্রত্যেক ভারতীয়ের রক্ত ফুটেছে: মন কি বাত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদী

জনপ্রিয় ভাষণ

প্রত্যেক ভারতীয়ের রক্ত ফুটেছে: মন কি বাত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদী
‘India has every right to defend itself’: Germany backs New Delhi after Operation Sindoor

Media Coverage

‘India has every right to defend itself’: Germany backs New Delhi after Operation Sindoor
NM on the go

Nm on the go

Always be the first to hear from the PM. Get the App Now!
...
একতার মহাকুম্ভ – নতুন এক যুগের সূচনা
February 27, 2025

পবিত্র প্রয়াগরাজ শহরে সফল এক মহাকুম্ভ সম্পন্ন হয়েছে। ঐক্যের মহাযজ্ঞ সম্পূর্ণ হল। কোন জাতির মধ্যে যখন চেতনা জাগ্রত হয়, তখন সেই জাতি দীর্ঘ কয়েক শতক পুরনো পরাধীনতার শিকলকে ভেঙে ফেলে, নতুন শক্তিতে মুক্ত বাতাস গ্রহণ করে। ১৩ জানুয়ারি থেকে প্রয়াগরাজে একতার মহাকুম্ভে তার-ই প্রতিফলন দেখা গেছে।

অযোধ্যায় রাম মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার সময় ২২ জানুয়ারি আমি দেবভক্তি এবং দেশভক্তির বিষয়ে বলেছিলাম। প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভ চলাকালীন দেব-দেবী, সাধু-সন্ত, মহিলা, শিশু, যুবক-যুবতী, প্রবীণ নাগরিকবৃন্দ থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের মানুষ এখানে জড়ো হয়েছেন। আমরা জাতির মধ্যে চেতনা জাগ্রত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছি। একতার এই মহাকুম্ভে একই জায়গায় একই সময়ে পবিত্র এক আয়োজনে ১৪০ কোটি ভারতবাসীর আবেগ পুঞ্জিভূত হয়েছে।

প্রয়াগরাজ অঞ্চলের পবিত্র শৃঙ্ঘারপুর হল ঐক্য, সম্প্রীতি এবং ভালোবাসার এক মহান ভূমি, যেখানে প্রভু শ্রীরাম এবং নিশাদরাজের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়। তাঁদের সেই সাক্ষাৎ আসলে নিষ্ঠা এবং সদিচ্ছার মিলন। আজও সেই একই মানসিকতায় প্রয়াগরাজ আমাদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

গত ৪৫ দিন ধরে আমি প্রত্যক্ষ করেছি দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে কোটি কোটি মানুষ সঙ্গমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। মিলনের সেই আবেগ আরো সঞ্চারিত হয়েছে। গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতীর পবিত্র সঙ্গমে ভক্তরা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় আস্থার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন।

প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভ নিয়ে আধুনিক যুগের ম্যানেজমেন্টের পেশাদার ব্যক্তিত্বরা পড়াশোনা করছেন। বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন যারা করেন, সেই বিশেষজ্ঞ এবং পরিকল্পনাকারীরাও এই মহাকুম্ভের বিষয়ে আগ্রহপ্রকাশ করেছেন। এর আগে বিশ্বের কোথাও এত বৃহৎ জনসমাগম হয় নি।

তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলে কোটি কোটি মানুষ জড়ো হওয়ার জন্য কিভাবে প্রয়াগরাজে এসেছেন সারা বিশ্ব তা প্রত্যক্ষ করেছে। এঁদের কাছে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কোন আমন্ত্রণপত্র পাঠায়নি, কোথায় যেতে হবে তা বলে দেয়নি, অথচ কোটি কোটি মানুষ স্বইচ্ছায় মহাকুম্ভের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন, পবিত্র অবগাহনের মাধ্যমে নিজেকে আশীর্বাদধন্য বলে মনে করেছেন।

পবিত্র স্থানের পর প্রত্যেকের মুখে যে অপার আনন্দ ও তৃপ্তি আমি প্রত্যক্ষ করেছি তা কোনদিনই ভোলার নয়। মহিলা, বয়স্কজনেরা, আমাদের দিব্যাঙ্গ ভাই ও বোনেরা – প্রত্যেকেই ঠিক সঙ্গমে পৌঁছোনোর রাস্তা খুজে পেয়েছেন।

ভারতের যুবসম্প্রদায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আয়োজনে সামিল হয়েছেন, যা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। মহাকুম্ভে তরুণ প্রজন্মের উপস্থিতি এক নতুন বার্তা দিয়েছে – আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একে সংরক্ষণ করার বিষয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে তাঁরা ওয়াকিবহাল হয়েছেন এবং এই দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন।

মহাকুম্ভ উপলক্ষে প্রয়াগরাজের বিপুল জনসমাগম নতুন এক রেকর্ড তৈরি করেছে। কিন্তু শারীরিক ভাবে উপস্থিত না হয়েও কোটি কোটি মানুষ এই উপলক্ষে এখানে মানসিক ভাবে সমাবেত হন। ভক্তরা যে পবিত্র জল নিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে গেছেন, সেই জল লক্ষ লক্ষ মানুষের আধ্যাত্মিক ভাবনার উৎসে পরিণত হয়েছে। মহাকুম্ভ ফেরত বহু পূণ্যার্থীকে নিজ নিজ গ্রামে সসম্মানে বরণ করে নেওয়া হয়েছে, সমাজ তাঁদের সম্মানিত করেছে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রয়াগরাজে যা ঘটেছে তা অভূতপূর্ব। এর মাধ্যমে আগামীদিনের দেশ গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে।

কেউ ভাবতেও পারেননি এত বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রী এখানে জড়ো হবেন। কুম্ভের অতীতের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এখানে কতজন আসতে পারেন, সেবিষয়ে প্রশাসন কিছু হিসেব-নিকেশ করেছিল, কিন্তু সেই প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে বহু মানুষ এখানে এসেছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতজন বসবাস করেন তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষ একতার এই মহাকুম্ভে এসেছিলেন।

কোটি কোটি উৎসাহী অংশগ্রহণকারী ভারতবাসীর বিষয়ে আধ্যাত্মিক জগতের বিশেষজ্ঞরা যদি পর্যালোচনা করেন, তাহলে তাঁরা দেখবেন নিজ ঐতিহ্যে গর্বিত দেশবাসী এখন নতুন এক উদ্দীপনায় ভরপুর হয়ে উঠেছেন। আমি তাই মনে করি নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছে, যা নতুন ভারতের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করবে।

হাজার হাজার বছর ধরে ভারতের জাতীয় ভাবনাকে মহাকুম্ভ শক্তিশালী করেছে। প্রতিটি পূর্ণ কুম্ভে সাধু-সন্ত, বিদ্বান ব্যক্তি এবং পণ্ডিতেরা জড়ো হতেন। তাঁরা সেই সময়ে সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করতেন। তাঁদের আলোচনার ওপর ভিত্তি করে দেশ এবং সমাজ নতুন এক দিশায় এগিয়ে চলতো। প্রতি ৬ বছর পর অর্ধকুম্ভের সময় গৃহীত নীতিগুলি পর্যালোচনা করা হতো। ১৪৪ বছর পর ১২টি পূর্ণ কুম্ভের শেষে সেকেলে ঐতিহ্যগুলিকে বাতিল করে দেওয়া হতো, নতুন নতুন ধারণা যুক্ত হতো, ভবিষ্যতের জন্য নতুন নতুন রীতি-নীতি কার্যকর করা হতো।

১৪৪ বছর পর এই মহাকুম্ভে ভারতের উন্নয়নযাত্রা সম্পর্কে আমাদের সাধু-সন্ন্যাসীরা নতুন এক বার্তা দিয়েছেন। সেই বার্তা হল বিকশিত অর্থাৎ উন্নত ভারত গড়তে হবে।

একতার এই মহাকুম্ভে ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে , তরুণ বা প্রবীণ, গ্রামবাসী বা শহরের বাসিন্দা, দেশ-বিদেশের মানুষ, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ – যে কোন প্রান্তের মানুষ এখানে মিলিত হয়েছেন। জাত, ধর্ম, নীতি, আদর্শ এ সব কিছু অগ্রাহ্য করে সঙ্গমে তাঁরা সমবেত হয়েছেন। এটি আসলে এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত ভাবনার প্রতিফলন, যেখানে কোটি কোটি মানুষের আস্থা রয়েছে। আর এখন আমরা সেই একই উৎসাহ, উদ্দীপনায় উন্নত ভারত গড়তে ব্রতী হব।

এই প্রসঙ্গে আমার ভগবান কৃষ্ণের সেই উপাখ্যানটি মনে পড়ছে। মা যশোদা তাঁকে মুখ খুলে হাঁ করতে বললে, তিনি যখন মুখ খুলেছিলেন, তখন তাঁর মা সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মান্ড প্রত্যক্ষ করেন। একই ভাবে এই মহাকুম্ভে দেশ-বিদেশের মানুষ ভারতের সম্মিলিত শক্তির সম্ভাবনাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে, একনিষ্ঠ ভাবে উন্নত ভারত গড়তে হবে।

অতীতে ভক্তি আন্দোলনের সময় সাধু-সন্ন্যাসীরা দেশ জুড়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংকল্পকে চিহ্নিত করে তাকে কাজে লাগাতে উৎসাহিত করেছিলেন। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের শক্তি সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শ্রী অরবিন্দ — প্রত্যেক মহান চিন্তাবিদ মনে করিয়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধীও সেই অভিজ্ঞতা লাভ করেন। স্বাধীনতা উত্তর যুগে এই সম্মিলিত শক্তিকে যদি যথাযথ ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো, তাহলে তা প্রত্যেকের কল্যাণে ব্যবহার করা যেত। ফল স্বরূপ নতুন এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি হিসেবে কাজে লাগান যেতো। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেই শক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তবে, বর্তমানে উন্নত ভারত গড়তে যে ভাবে জনগণের সম্মিলিত শক্তি আত্মপ্রকাশ করছে তা দেখে আমি আনন্দিত।

বৈদিক যুগ থেকে বিবেকানন্দ , প্রাচীন যুগের নীতি থেকে আধুনিক যুগের কৃত্রিম উপগ্রহ – দেশের মহান রীতি-নীতি সবসময়ই জাতি গঠনে সহায়ক হয়েছে। নাগরিক হিসেবে আমি চাইবো আমাদের পূর্বপুরুষ এবং সাধু-সন্ন্যাসীদের কর্ম তৎপরতা অনুপ্রেরণার নতুন উৎস হোক। একতার এই মহাকুম্ভ নতুন নতুন সংকল্পকে বাস্তবায়িত করতে সহায়তা করুক। আসুন আমরা ঐক্যকে আমাদের পথপ্রদর্শক নীতি হিসেবে গ্রহণ করি। দেশ সেবা আসলে অধ্যাত্ম সেবার সমার্থক – এই ভাবনায় আমরা এগিয়ে চলি।

কাশীতে আমার নির্বাচনী প্রচারের সময়কালে আমি বলেছিলাম, “মা গঙ্গার আহ্বানে আমি এখানে এসেছি”। এটি নিছক কোন আবেগ ছিল না। এর মধ্য দিয়ে পবিত্র নদীগুলিকে পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে আমাদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি অন্তর্নিহীত ছিল। প্রয়াগরাজে গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী নদীর সঙ্গমে দাঁড়িয়ে আমার সেই সংকল্প আরও দৃঢ় হয়েছে। আমাদের নদীগুলির পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার সঙ্গে নিজেদের জীবনযাত্রা যুক্ত রয়েছে। তাই বড় বা ছোট যেরকমেরই নদী হোক সেই নদীকে জীবনদায়ী মাতা হিসেবে আমরা পুজো করবো। আমাদের নদীগুলিকে পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, এই মহাকুম্ভ তাকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে।

আমি জানি এধরনের একটি বৃহৎ কর্মকান্ডকে বাস্তবায়িত করা সহজ কোন কাজ নয়। আমাদের নিষ্ঠায় কোন ঘাটতি থাকলে তার জন্য আমি মা গঙ্গা, মা যমুনা এবং মা সরস্বতীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতিমূর্তি জনতা জনার্দনকে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের তরফে যদি কোনরকমের খামতি থাকে, তার জন্য আমি সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

এই মহাকুম্ভে অগণিত মানুষ যে আধ্যাত্মিক চেতনায় জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে একই রকমের ভাবনায় আমরা কাজ করেছি। উত্তর প্রদেশের সাংসদ হিসেবে আমি বলতে চাই যোগীজির নেতৃত্বে প্রশাসন এবং জনসাধারণ যে ভাবে এই একতার মহাকুম্ভকে সফল করে তুলেছেন তার জন্য আমি গর্বিত। রাজ্য অথবা কেন্দ্র, প্রশাসক অথবা শাসক – কারোর পক্ষে একক ভাবে এই আয়োজন সফল করা সম্ভব নয়। নিকাশী ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্মী, পুলিশ, নৌকো চালক, গাড়ি চালক, খাদ্য সরবরাহকারী - প্রত্যেকে একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে এখানে নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন। প্রয়াগরাজের জনসাধারণ নিজেদের হাজারও অসুবিধা সত্বেও যে ভাবে তীর্থযাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছেন, তা এককথায় অনবদ্য। আমি প্রয়াগরাজের জনসাধারণ সহ উত্তরপ্রদেশের প্রত্যেককে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁরা এক অসাধারণ কাজ করেছেন।

আমাদের দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়ে আমার সবসময়ই অটুট আস্থা রয়েছে। এবারের মহাকুম্ভ প্রত্যক্ষ করে সেই আস্থা বহুগুণ শক্তিশালী হয়েছে।

যেভাবে ১৪০ কোটি ভারতবাসী একতার মহাকুম্ভকে আন্তর্জাতিক এক কর্মসূচিতে পরিণত করেছেন, তা অবিশ্বাস্য। আমাদের জনগণের নিষ্ঠা, অধ্যবসায় এবং উদ্যোগে আমি আপ্লুত। দেশবাসীর এই সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে যে সাফল্য আমরা অর্জন করেছি, আমি তা শ্রী সোমনাথকে নিবেদন করবো। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে আমি প্রথমে সেখানে যাব এবং তার কাছে প্রত্যেক দেশবাসীর জন্য প্রার্থনা করবো।

মহাশিবরাত্রীর দিনে মহাকুম্ভ হয়তো আনুষ্ঠানিক ভাবে শেষ হয়েছে, কিন্তু গঙ্গার শাশ্বত প্রবাহের মতো আমাদের আধ্যাত্মিক শক্তি, জাতীয় ঐক্য ও চেতনা জাগ্রত থাকবে, যেগুলিকে মহাকুম্ভ আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সঞ্চারিত করেছে। এই শক্তি, ঐক্য ও চেতনা আমাদের আগামী প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করবে।